প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে কী খেতে হয় - ঘন ঘন প্রস্রাব কিসের লক্ষণ

প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে কি খেতে হয় ও ঘনঘন প্রস্রাব কিসের লক্ষণ, এই দুই বিষয়ে আপনারা আমাদের কাছে প্রশ্ন করে থাকেন। গরমে একটি সাধারণ সমস্যা প্রসাবে ইনফেকশন বা ইউটিআই। বিশ্বজুড়ে এই রোগে সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।
এবং ঘন ঘন প্রস্রাব কিসের লক্ষণ হতে পারে এ সম্পর্কেও আমাদের ধারণা থাকা উচিত। কেননা ইনফেকশনে হওয়ার আগে লক্ষন দেখে বলতে পারি । আসুন জেনে নিই, প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে কি খেতে হয় এবং ঘন ঘন প্রস্রাব কিসের লক্ষণ।

সূচিপত্র: প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে কী খেতে হয়

.

প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে কি খেতে হয়

ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে যখন মূত্রনালীর নিম্নাংশ আক্রান্ত হয় তখন চিকিৎসাশাস্ত্রে এই পরিস্থিতিকে বলা হয় মূত্রথলির সংক্রমণ বা সিস্টাইটিস আর মাত্রনালির উধ্বাংশ আক্রান্ত হলে তাকে কিডনি সংক্রমণ বা পায়েলোনেফ্রাইটিস বলে ধরে নেন বিশেষজ্ঞরা। নারী কিংবা পুরুষ উভয়েই রোগী আক্রমণ হতে পারে। 

আমেরিকার হেলথ লাইনে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পুরুষের তুলনায় নারীরা প্রসবের সংক্রমণে বেশি ভোগেন। কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীদের মূত্রনালী যে টিউব মুত্রাশয় থেকে প্রস্রাব বহন করে তা পুরুষের মূত্রনালী থেকেও ছোট। তাই মূত্রনালী আর মুত্রাশয়ের দূরত্ব নারীদের কম হওয়ায় সহজে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ হয়ে পড়ে। 

প্রসাবের সংক্রমণের কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, যৌনকর্ম, বয়স, ডায়াবেটিস, গর্ভকালীন সময় কেউ দায়ী করেছে চিকিৎসকরা। ইউটিআই ইনফেকশনের শিকার হলে রোগীর মধ্যে বেশি কিছু লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠে। 

যেমন প্রস্রাবের রাস্তায় জ্বালাপোড়া, প্রস্রাবের রাস্তায় চুলকানি হওয়া, তলপেটে ব্যথা, প্রস্রাব করতে অসুবিধা অনুভব করা, বার বার অল্প পরিমাণে প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবের অস্বাভাবিকভাবে প্রচন্ড চাপ অনুভব করা, দুর্গন্ধময় ঘোলাটে প্রস্রাব হয় ইত্যাদি।

এসব লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠলে বিচলিত না হয়ে প্রস্রাবে ইনফেকশন সারাতে বাড়িতেই কিছু নিয়ম মেনে চলতে পারেন। যেমন-

১। প্রথমেই যে কাজটি করবেন তাহলো বেশি বেশি পানি করা। কারণ ইউটিআইয়ের অন্যতম একটি কারণ হলো শরীরে পানির অভাব বা ডিহাইড্রেশন।

২। প্রস্রাবে ইনফেকশন থেকে প্রাকৃতিকভাবে মুক্ত হতে ফ্লুইডযুক্ত তরল খাবার খান। রঙিন ফলে প্রচুর পরিমাণে ফ্লুইড থাকে।

৩। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার দারুণ কাজ করে প্রস্রাবের সংক্রমণের বিরুদ্ধে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিটামিন সি শুধু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই বাড়ায় না, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস করে। নিয়মিত ভিটামিন সি খাওয়ার অভ্যাসে প্রস্রাব বেশি পরিমাণে অ্যাসিডিক হয়ে ওঠে যা প্রস্রাবে ইনফেকশন তৈরি করা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে।

৪। ক্র্যানবেরি ফল ও ফলের জুস ভালো কাজ করে প্রস্রাবে ইনফেকশন মুক্তিতে। প্রোবায়োটিক খাবারও এ সমস্যা দূর করতে কার্যকরী। দই প্রোবায়োটিকসমৃদ্ধ খাবার। এ খাবার গ্রহণে শরীরে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়ে।

৫। ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চললে প্রস্রাবের সংক্রমণ অনেকটাই কমে আসে। এরজন্য প্রথমে যে কাজটি করবেন বেশি সময় ধরে প্রস্রাবের বেগ আটকে রাখবেন না। পাশাপাশি প্রস্রাবের সংক্রমণ কমাতে টয়লেট ব্যবহারে সচেতনতা ও ব্যক্তিগত অঙ্গের পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করুন।

ঘন ঘন প্রস্রাব কিসের লক্ষণ?

ঘন ঘন প্রস্রাবরা রাতে বারবার শৌচাগারে যাওয়া, ইউ উপসর্গ দেখা দিলে সকলের শম্কিত হন। তার মানে কি ডায়াবেটিস হয়েছে? বয়স্কদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। অন্তঃসত্ত্বারাও এই সমস্যায় ভোগেন। জেনে রাখুন, ডায়াবেটিসের একটি অন্যতম লক্ষণ হলেও ঘনঘন বা অধিক প্রসাব অন্যান্য সমস্যার কারণে হতে পারে। 

একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি দিনে চার থেকে ৮ বার মূত্র ত্যাগ করে থাকেন। পরিমাণ যাই হোক না কেন, দিনে আটবারের বেশি প্রসাব করলে তাকে ঘনঘন প্রস্রাব হিসেবে গণ্য করা হয়। বিভিন্ন বয়সের প্রস্রাব স্বাভাবিক পরিমাণ বিভিন্ন।তবে স্বাভাবিক অবস্থায় কোনও পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির প্রস্রাবের পরিমাণ ২৪ ঘন্টায় তিন লিটার বা এর অধিক হলে তা অস্বাভাবিক। 

চিকিৎসার পরিভাষায় একে বলে 'পলিইউরিয়া'। ঘন ঘন প্রস্রাব বা অধিক পরিমাণ প্রস্রাব— উপসর্গ দুটো আলাদা। অনেক ক্ষেত্রেই এ দুটো একসঙ্গে দেখা যায়। কেন না প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে গেলে প্রস্রাব ঘন ঘন হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই ঘন ঘন প্রস্রাবের মূল কারণ হল অধিক বা অস্বাভাবিক পরিমাণে জল খাওয়া। 

একে ‘সাইকোজেনিক পলিডিপসিয়া’ বলা হয়। কিছু ক্ষেত্রে শারীরবৃত্তীয় কারণেই বেশি প্রস্রাব হতে পারে। যেমন অতিমাত্রায় পানীয় বা অ্যালকোহল সেবন, ক্যাফিনযুক্ত পানীয় গ্রহণ, শীতকালে যখন ঘামের পরিমাণ কমে যায়, গর্ভাবস্থায়, প্রস্রাব বৃদ্ধিকারক ওষুধ সেবন, ১০ হাজার ফুট উপরে ভ্রমণের সময়ে কিংবা অধিক মাত্রায় ভিটামিন সি ও বি২ গ্রহণ ইত্যাদি। এই সব কারণ খুবই স্বাভাবিক। তবে শরীরে কিছু রোগ বাসা বাঁধলেও ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা হতে পারে। জেনে নিন সেগুলি কী কী।

ডায়াবেটিক ছাড়াও অন্য যে সব কারণে ঘনঘন প্রস্রাব হয়ঃ

১) মূত্রনালি কিংবা মূত্রথলির সংক্রমণ।

২) গর্ভাবস্থার প্রথম ও শেষ দিকে।

৩) বয়স্ক পুরুষদের প্রস্টেট গ্রন্থির সমস্যায়।

৪) স্নায়ুরোগ, মূত্রথলির স্নায়ুবিকলতা, মূত্রথলির ক্যানসার।

৫) মস্তিষ্কের টিউমার, অস্ত্রোপচার, আঘাত, কিডনি রোগের কারণে মূত্র নিয়ন্ত্রক এডিএউচ হরমোনের অভাব বা অকার্যকারিতা দেখা দেয়।

৬) শরীরে থাইরয়েড হরমোন বা করটিসল হরমোনের আধিক্য হলে।

৭) রক্তে ক্যালশিয়াম বা পটাশিয়ামের তারতম্য ঘটলে।

ঘন ঘন প্রস্রাব বা অধিক পরিমাণ প্রস্রাব কোনও রোগ নয় বরং রোগের উপসর্গ মাত্র। এর কারণে শরীরে জলশূন্যতা, জলের ভারসাম্যহীনতা, সোডিয়ামের ভারসাম্যহীনতার সমস্যা হতে পারে। তাই এ সমস্যায় আক্রান্ত হলে অবশ্যই ডায়াবিটিস বা অন্যান্য সমস্যা আছে কি না, তা পরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি।

দৈনিক কতবার প্রস্রাব করা ভালো?

দিনে কতবার প্রস্রাব করলে স্বাভাবিক ধরা হবে? এই প্রশ্নটি আপনারা আমাদের কাছে করে থাকেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক কতবার প্রস্রাব করা ভালো? একদিনে অর্থাৎ 24 ঘন্টায় একজন সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাক্তির অন্তত 2 লিটার জল পান করা উচিৎ। সে অনুযায়ী সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক কারও জন্য দিনে ছয় থেকে আটবার প্রস্রাব করা স্বাভাবিক। প্রতিদিন চার থেকে দশবার প্রস্রাব কারাও স্বাস্থ্যকর ধরে নেওয়া যায়।

২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইউটিআই থেকে মুক্তির উপায়?

মূত্রনালীতে সংক্রমণ বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই) সব সময়ই অতর্কিতে হানা দেয়। সংক্রমণের পর তার বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিলে বা চিকিৎসা না করালে এই রোগ একাধিক বার শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। অনেকে ইউটিআই-তে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই বাজারচলতি কিছু ওষুধ ও জেল ব্যবহার করতে শুরু করেন। 

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা অত্যন্ত খারাপ। বরং এতে সংক্রমণ কমে না, তার বদলে তা অনেক সময় শরীরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। ওষুধ বন্ধ করার কিছু দিনের মধ্যেই প্রবল ভাবে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই প্রথম থেকেই এই অসুখের সময় বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। 

প্রস্রাবের সংক্রমণ-জনিত জ্বর হলে সে ক্ষেত্রে সর্দি-কাশি বা গলা ব্যথা থাকে না। শীত করে, প্রস্রাব করার সময়ে ব্যথা ও জ্বালা অনুভূত হয়, তলপেটে ব্যথা করে, প্রস্রাবে দুর্গন্ধ হয়, প্রস্রাব ঘোলাটে বা লালচে হতে পারে। শরীর দুর্বল লাগে, খেতে ভাল লাগে না, বমি হয় বা বমি বমি ভাব থাকে। 

এই ধরনের লক্ষণ দেখলে রুটিন ইউরিন টেস্ট ছাড়া ইউরিন কালচার এবং দরকার হলে আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান, এক্স রে করতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনেই ওষুধ খান। এ ছাড়া কিছু ঘরোয়া প্রতিকারেও মিলতে পারে উপশম।

ইউটিআই-এর কয়েকটি কার্যকরী ঘরোয়া প্রতিকার:

পরিমিত জল খান: ইউরিন ইনফেকশন হলে কিংবা ঘন ঘন ইউরিন ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা থাকলে শরীরে যাতে জলের ঘাটতি না হয়, সে বিষয় নজর রাখুন। প্রস্রাবে হলুদ ভাব দেখা গেলেই দেরি না করে দিনে অন্তত আড়াই লিটার জল খাওয়া শুরু করা উচিত। সাধারণত প্রতি ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা পর পর প্রস্রাব হওয়া উচিত। প্রস্রাব হতে এর চাইতে বেশি দেরি হলে জলের পরিমাণ আরও বাড়াতে হতে পারে। খুব বেশিক্ষণ প্রস্রাব চেপে রাখবেন না, এতে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

খাদ্যতালিকায় ভিটামিন সি রাখুন: ইউটিআই হলে অনেক চিকিৎসক বেশি পরিমাণে ভিটামিন-সি জাতীয় খাদ্য খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ভিটামিন সি প্রস্রাবের সময় জ্বালা ভাব কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও ভিটামিন সি ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে। তাই ইউরিন ইনফেকশন হলে খাদ্যতালিকায় মুসাম্বি, কমলালেবু, কিউয়ি, ব্রকোলি, পেঁপে, স্ট্রবেরি ‌ অবশ্যই রাখুন।

আনারস খেতে পারেন: আনারসে আছে ব্রোমেলাইন নামক একটি উপকারী উৎসেচক। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ইউটিআই-এ আক্রান্ত রোগীদের সাধারণত ব্রোমেলাইন সমৃদ্ধ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। তাই ইউরিন ইনফেকশন হলে প্রতিদিন আনারসের রসও খাওয়া যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ক্র্যানবেরির রসও এই সমস্যা সমধানে বেশ উপকারী।

প্রোবায়োটিক জাতীয় খাদ্য খান: এই সময় প্রোবায়োটিক জাতীয় খাদ্য বেশি পরিমাণে খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এই প্রকার খাদ্য ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। দই প্রোবায়োটিকের ভাল উৎস। দই খেলেও উপকার পেতে পারেন।

বেকিং সোডা ব্যবহার করতে পারেন: মূত্রনালীতে সংক্রমণ হলে তা কিডনিতে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। তাই দ্রুত এর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে বেকিং সোডা দ্রুত মূত্রনালীতে সংক্রমণ সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। আধ চামচ বেকিং সোডা এক গ্লাস জলে ভাল করে মিশিয়ে দিনে এক বার করে খেলেই প্রস্রাবের সময় জ্বালা বা ব্যথা ভাব কমে যেতে পারে। তবে বেশি মাত্রায় বেকিং সোডা শরীরের ক্ষতি করতে পারে, তাই সতর্ক থাকুন।

সর্বশেষ আলোচনা

প্রিয় পাঠক, ইতিমধ্যে প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে করণীয় কি?, ঘন ঘন প্রস্রাব কিসের লক্ষণ? ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়ে গিয়েছে। এই আর্টিকেলটি শুধু মেয়েদের জন্য নয়, মেয়েছেলে উভয়ের জানা উচিত।

আশা করছি আপনি আমাদের পোস্টে পড়ার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন এবং প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে করনীয় কি তা সম্পর্কে ধারণা নিতে পেরেছেন এবং কিছু কার্যকরী বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। আমাদের পোস্টটি যদি ভালো লেগে থাকে, তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটটি ফলোই আমাদের সাথেই থাকুন ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url